কুরআন মাজিদে সন্দেহের একটি ছায়া খুঁজে দেখাও


এই সেই কিতাব, যাতে কোনো সন্দেহ নেই। মুত্তাকিদের (যারা
আল্লাহর প্রতি তাদের করণীয়সমূহ সম্পর্কে সচেতন তাদের) জন্য
হেদায়াত। (বাকারা, ০২ : ০২)

 

আর আমি আমার বান্দার ওপর (কুরআন মাজিদে) বিভিন্ন সময়ে
যা নাজিল করেছি যদি তোমরা সে সম্পকের্ সন্দেহে থাক তবে
তোমরা তার মত একটি ‘সুরা’ নিয়ে আস এবং আল্লাহ ছাড়া
তোমাদের সাক্ষীসমূহকে ডাক; যদি তোমরা (তোমাদের সন্দেহের
ক্ষেত্রে) সত্যবাদী হও। (বাকারা, ০২ : ২৩)

 

এই কুরআন তো এমন নয় যে, আল্লাহ ছাড়া কেউ তা রচনা
করতে পারবে; বরং এটি যা (যে ওহি) তার সামনে, তার সত্যায়ন
এবং কিতাবের বিস্তারিত ব্যাখ্যা, যাতে কোনো সন্দেহ নেই, যা
সৃষ্টিকুলেন রবের পক্ষ থেকে। (ইউনুস, ১০ : ৩৭)

এ কিতাব সৃষ্টিকুলের রবের পক্ষ থেকে অবতীর্ণ। এতে কোনো
সন্দেহ নাই। (সাজদাহ, ৩২ : ০২)

লক্ষণীয় বিষয় হল, এই আয়াতগুলি কাফিরদেরকে কুরআন মাজিদের ভুলত্রুটি,
অসঙ্গতি কিংবা অনৈক্য খুঁজে বের করতে বলে না, বরং কুরআন
মাজিদে একটি সাধারণ সন্দেহের ছায়া খুঁজে বের করতে বলে। মানব
ইতিহাসে এমন কোনো বইয়ের নজির নেই যার লেখক এই দাবি করতে
পেরেছেন। কুরআন মাজিদই একমাত্র গ্রন্থ যা এই দাবি করেছে।

এখন আমরা সেসব বিবিধ সন্দেহের বিশ্লেষণ করি যা কোনো বই সম্পর্কে
একজন মানুষের হতে পারে। তা এমন একজন ব্যক্তির দ্বারা লিখিত, রচিত
বা প্রচারিত হতে পারে, যিনি মানব সমাজে অপরিচিত কিংবা তা এমন
একজন ব্যক্তির দ্বারা লিখিত, রচিত বা প্রচারিত হতে পারে, যার চরিত্র,
আচরণ কিংবা ন্যায়পরায়নতা সন্দেহপূর্ণ। মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া
সাল্লাম-এর জীবন ইতিহাসের এক অনস্বীকার্য বাস্তবতা যে, তাঁর জীবনের
ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র অংশ পর্যন্ত সংরক্ষিত, লিখিত এবং বিশ্বস্ততার সঙ্গে এক প্রজন্ম
থেকে আরেক প্রজন্মে হস্তান্তরিত হয়ে এসেছে। বস্তুত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু
আলাইহি ওয়া সাল্লাম-ই মানব ইতিহাসের একমাত্র ব্যক্তি যার জীবন বৃত্তান্ত
বিগত চৌদ্দশ বছরের প্রত্যেক যুগের মুসলমানরাই লিপিবদ্ধ করেছে।
অধিকন্তু এ সকল বিবরণ এতই ব্যাপক যে, তারা কেবল তার জীবন-বৃত্তান্ত
লিখেই ক্ষান্ত হয় নি, বরং তাঁর ব্যক্তিগত আচরণ, সামাজিক সম্পর্ক,
আদান-প্রদান, কথা বলার ধরণ, হাঁটা-চলা, নিদ্রা যাওয়া, প্রাকৃতিক ডাকে
সাড়া দেওয়া, পোশাক-পরিচ্ছদ এবং তাঁর দেহাবয়বের ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র বিষয়ের
ওপরও আলোকপাত করেছে। যেমন- তাঁর দাড়িতে শুভ্র চুলের পরিমাণ
কত ইত্যাদি। মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর চরিত্র-বৈশিষ্ট্য,
আচার-আচরণ ও ন্যায়পরায়নতা সম্পর্কে এতটুকু বলাই যথেষ্ট যে, মক্কায়
তাঁর ঘোর শত্রুরাও তাঁকে ‘সিদ্দিক’ (সত্যবাদী) এবং ‘আল-আমিন’
(বিশ্বাসী) উপাধিতে ভূষিত করে। মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-
এর জীবন-ইতিহাস, চারিত্রিক ন্যায়পরায়নতা ও আচার-আচরণ সম্পর্কিত
বাস্তব ঘটনাবলি এমন নির্ভুলভাবে সংরক্ষণের পর সেই ব্যক্তি সম্পর্কে
কোনো সংশয় থাকতে পারে না যিনি মানব জাতির কাছে কুরআনের বাণী
প্রচার করেছেন। তিনি ইতিহাসের এক বিস্ময়কর ব্যক্তিত্বই নন, বরং
একজন প্রখ্যাত ও স্বতঃসিদ্ধ সত্যের প্রচারক।
অতএব এ থেকে বুঝা যায়, কুরআন মাজিদের উৎসের ক্ষেত্রে কোনো
ধরণের সন্দেহের অবকাশ নেই।
দ্বিতীয় প্রকার সন্দেহ, যা একটি গ্রন্থে সৃষ্টি হতে পারে তা, তার অন্তর্নিহিত
সঙ্গতির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। যদি একটি গ্রন্থের কিছু বর্ণনা অন্য বর্ণনার সঙ্গে
অসামঞ্জস্যপূর্ণ হয় তবে তা একটি গ্রন্থের অন্তর্নিহিত সঙ্গতি কিংবা
সামঞ্জস্যের ক্ষেত্রে সন্দেহের সৃষ্টি করতে পারে। পুরো কুরআন মাজিদে
৬,২৩৬টি আয়াত এবং ৮৬,৪৩২টি শব্দ রয়েছে।
তথাপি কুরআন মাজিদের একটি সাধারণ আয়াত, প্রবাদ-প্রবচন, বাগধারা
কিংবা শব্দ অন্য অংশের সঙ্গে সাংঘর্ষিক নয়। পক্ষান্তরে প্রত্যেকটি আয়াত
ও শব্দ সমগ্র কুরআন মাজিদের টেক্সটের সঙ্গে পূর্ণ সামঞ্জস্যপূর্ণ। পাঠক
এই বিষয়টি সহজে বুঝতে পারবেন, যদি বর্তমান বাইবেল সম্পর্কে কেবল
দু’টি উদ্ধৃতি দেয়া হয়। প্রটেস্টেন্ট খ্রিস্টানদের বাইবেলের কপিতে বই
সংখ্যা ৬৬টি, যার মধ্যে ৩৯টি বই পুরাতন সমাচার থেকে এবং ২৭টি বই
নতুন সমাচার থেকে। অপরপক্ষে ক্যাথলিক খ্রিস্টানদের বাইবেলের
কপিতে বই সংখ্যা ৭৩টি; ৬৬টি বই প্রটেস্টেন্ট খ্রিস্টানদের কপি থেকে
এবং ৬টি অতিরিক্ত বই যেগুলি Apocrypha (অ্যাপোক্রাইফা) নামে
পরিচিত।
বাইবেলের এই দুই ধরনের ভার্সনের অস্তিত্ব থাকার কারণে পুরো
বাইবেলের বিশ্বাসযোগ্যতার ওপর সুস্পষ্ট সন্দেহের সৃষ্টি হয়। প্রশ্ন জাগে
গ্রন্থটির কোন ভার্সনটি গ্রহণ করা যাবে, প্রটেস্টেন্ট ভার্সন না ক্যাথলিক
ভার্সন?
বাইবেলের একটি বিস্ময়কর অসঙ্গতি হল, এটি যীশু খ্রিস্টের (ঈসা
আলাইহিস সালাম-এর) দু’টি ভিন্ন ভিন্ন বংশ তালিকা প্রদান করে। বাইবেল
অনুসারে, তার একজন পূর্বপুরুষের নাম হল যোসেফ। মেথিউ ১ : ১-৭
অনুসারে যোসেফের পিতার নাম জ্যাকব। পক্ষান্তরে লূক ৩ : ২৩ অনুসারে
যোসেফের পিতার নাম হেলি।
আল হামদুলিল্লাহ। কুরআন মাজিদের কেবল একটি ভার্সনই সদা বিদ্যমান
থেকেছে এবং এর টেক্সটও সবধরনের অসঙ্গতিরহিত। সেহেতু সন্দেহের
দ্বিতীয় রূপ অর্থাৎ গ্রন্থের আভ্যন্তরীণ সঙ্গতি ও সামঞ্জস্য অনুসারেও কুরআন
মাজিদে কোনো ধরনের সন্দেহ নেই।
একটি গ্রন্থে তৃতীয় প্রকার যে সন্দেহের সৃষ্টি হয় তা তার বাহ্যিক সঙ্গতির
সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। তার অর্থ, গ্রন্থটিতে এমন কোনো বর্ণনা থাকবে না, যা
গ্রন্থটির বাইরের জগতের স্বতঃসিদ্ধ ও প্রতিষ্ঠিত জ্ঞানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক
হবে। বিগত পৃষ্ঠাগুলি তার কিছু নমুনা প্রদান করে যে, কুরআন মাজিদের
বর্ণনা শরীরবিদ্যা, জ্যোতির্বিদ্যা, উদ্ভিদবিদ্যা, ভ্রূণবিদ্যা, পদার্থবিদ্যা,
ব্যবচ্ছেদবিদ্যা, প্রাণীবিদ্যা ইত্যাদি বিভিন্ন বিষয়সহ কোনো মানবজ্ঞান
জগতের সঙ্গেই অসঙ্গতি রাখে না। অধিকন্তু কুরআন মজিদ মানব জ্ঞানের
সকল স্তর থেকে শ্রেষ্ঠত্বের মর্যাদা রাখে, চাই তা প্রাচীন, সাম্প্রতিক কিংবা
অতি সাম্প্রতিকই হোক না কেন।
এভাবে কুরআন মজিদ বাহ্যিক সঙ্গতির পরীক্ষায় সফলভাবে উত্তীর্ণ।
কোনো মানুষই এমন কোনো গ্রন্থ রচনা করতে পারে নি যা চিরকাল বাহ্যিক
সঙ্গতির বিষয়টি রক্ষা করতে পেরেছে। প্রত্যেক বই-ই সময়ের সঙ্গে একটি
ধাপ পেরিয়ে গেলে সেকেলে এবং মেয়াদোত্তীর্ণ হয়ে পড়ে। কুরআন
মাজিদই একমাত্র গ্রন্থ যা সফলতার সঙ্গে বিগত চৌদ্দশ বছর যাবৎ বাহ্যিক
সঙ্গতির চ্যালেঞ্জ মুকাবেলা করেছে। মহাজ্ঞানী ও সর্বজ্ঞাতা আল্লাহ
তাআলাই এমন একটি গ্রন্থ অবতীর্ণ করতে পারেন, যা এমন সর্বব্যাপী জ্ঞান
ধারণ করে যা সকল যুগের মানুষের জ্ঞানকে পরিব্যাপ্ত করে এবং সকল
জ্ঞান জগতের ওপর নিরংকুশ শ্রেষ্ঠত্ব রাখে।

মূলঃআল কুরআনের ১৬০ মুজিজা ও রহস্য[পৃষ্ঠাঃ ১৯৬-১৯৯]
ড. মাজহার কাজি
ভাষান্তর
মুহাম্মদ ফয়জুল্লাহ মুজহিরী
সম্পাদনা
এম মুসলেহ উদ্দিন
মুহাম্মদ শামসুল হক সিদ্দিক
অন্যথা পাবলিকেশন

*****************

Leave a comment